অলটেক্সের তালিকাবহির্ভূত দুই কোম্পানি বেচে দেবে ব্যাংক
প্রচ্ছদ » Uncategorized » অলটেক্সের তালিকাবহির্ভূত দুই কোম্পানি বেচে দেবে ব্যাংকপুঁজিবাজার রিপোর্ট ডেস্ক: একসময় দেশের শীর্ষস্থানীয় হোম টেক্সটাইল রফতানিকারক হিসেবে সুনাম ছিল অলটেক্সের। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনেকেই পরে নিজে ব্যবসা করে সফল হওয়ার উদাহরণ গড়েছেন। তবে অলটেক্সের পারফরম্যান্স গ্রাফ ক্রমে নিম্নমুখী হয়েছে। খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি সুদ মওকুফ সুবিধা পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি। বছর বছর বেড়েছে দেনার অংক। শেষ চেষ্টা হিসেবে আবারো সুদ মওকুফ করে গ্রুপের তালিকাবহির্ভূত দুই কোম্পানির সব সম্পদ বেচে ঋণ সমন্বয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সোনালী ব্যাংক। বাকি পাওনা তালিকাভুক্ত কোম্পানি অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ঋণ হিসেবে পুনঃতফসিল করারও পরিকল্পনা করেছে তারা।
সোনালী ব্যাংক সূত্র জানায়, সম্প্রতি তাদের পর্ষদ সভায় অলটেক্স গ্রুপের ঋণ সমন্বয় ও সুদ মওকুফের প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। প্রস্তাব অনুসারে, অলটেক্স গ্রুপের কাছে সোনালী ব্যাংকের মোট পাওনা ৩৬৫ কোটি টাকার মধ্যে ১৩৭ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হবে। এরপর অলটেক্স গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান অলটেক্স স্পিনিং ও অলটেক্স ফ্যাব্রিকসের সমুদয় সম্পদ ১১০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয়া হবে। এ থেকে সোনালী ব্যাংক পাবে ৭৩ কোটি টাকা আর ৩৭ কোটি টাকা পাবে অগ্রণী ব্যাংক। এর পরেও গ্রুপটির কাছে ব্যাংকের আরো ১১৮ কোটি টাকা পাওনা থেকে যাবে। আর এ অর্থ গ্রুপটির তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ঋণ হিসেবে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হবে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পেলেই বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির উদ্যোগ নেবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ব্যাংকাররা আরো জানিয়েছেন, গত বছর গ্রুপটিকে ১২৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ সুবিধা দেয়া হয়েছিল। তবে ডাউন পেমেন্ট দিতে না পারায় সে সুবিধা বাতিল হয়ে যাওয়ায় এ বছর সুদ আরো বেড়েছে।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল মাসুদ বলেন, অলটেক্সের সুদ মওকুফ ও ঋণ সমন্বয়ের একটি প্রস্তাব ব্যাংকের সর্বশেষ পর্ষদ সভায় অনুমোদন হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়াসাপেক্ষে এটি চূড়ান্ত হবে। তখন আমরা গ্রুপের দুটি কোম্পানির সব সম্পদ বিক্রি করার উদ্যোগ গ্রহণ করব।
বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় শাখার কাছে অলটেক্স গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠান অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, অলটেক্স ফ্যাব্রিকস ও অলটেক্স স্পিনিংয়ের মোট দেনা দাঁড়িয়েছে ৩৬৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকটির সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে তালিকাভুক্ত অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে, ২৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া অলটেক্স ফ্যাব্রিকসের কাছে ব্যাংকের ৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং আরো ৮০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে অলটেক্স স্পিনিংয়ের কাছে।
এদিকে ঋণ সমন্বয়ে কোম্পানির সম্পদ বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে অলটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ আসিফ বলেন, আমরা সোনালী ব্যাংকের কাছে ঋণ সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি বিবেচনা করতে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে এখনো কোনো লিখিত চিঠি পাইনি। তবে আশা করছি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দিলে আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই ঋণ সমন্বয়ের বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
এদিকে হোম টেক্সটাইল ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে সম্প্রতি জুতার ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ। চামড়া, কৃত্রিম চামড়া, রেক্সিন, প্লাস্টিক ও বিভিন্ন সিনথেটিক উপাদান কিংবা কাপড় দিয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের স্যু, স্যান্ডেল, বুট, ট্রেইনার ও স্পোর্টস সুজ উত্পাদন, বিপণন ও রফতানি করবে প্রতিষ্ঠানটি। জুতার পাশাপাশি বেল্ট, ব্যাগ ইত্যাদিও তৈরি করবে তারা। স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি এসব পণ্য রফতানির পরিকল্পনা করেছে অলটেক্সের।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ আসিফ বলেন, বর্তমানে অলটেক্সসহ অন্য যারা হোম টেক্সটাইল পণ্য উত্পাদন করছে, তারা সবাই ব্যবসায়িকভাবে চাপের মুখে রয়েছে। তাই ব্যবসায় বৈচিত্র্য এনে কোম্পানির আয় বাড়াতে আমরা জুতার ব্যবসা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এজন্য নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত বিদ্যমান কারখানায় অব্যবহূত জমিতে জুতা উত্পাদনের জন্য একটি ইউনিট স্থাপন করা হবে। এ মাসের ২৭ তারিখে এ বিষয়ে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আহ্বান করা হয়েছে। তাদের অনুমোদনসাপেক্ষে নতুন জুতা উত্পাদন ইউনিট স্থাপনের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে ৩৪ কোটি টাকার ডিমান্ড ঋণ নেয় অলটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ২০১১ সালে নেয় আরো ৯২ কোটি টাকার ঋণ। সুদাসলে শুধু অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কাছেই সোনালী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ২৩৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যদিও এ ঋণ পরিশোধে ২০১৫ সালে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ঋণের ওপর প্রযোজ্য মোট সুদের ৮৭ শতাংশ বা ৭২ কোটি টাকাই মওকুফ করে সোনালী ব্যাংক। মওকুফের পর পাওনা দাঁড়ায় ১৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সুদহারও কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এজন্য ডাউন পেমেন্ট হিসেবে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ সোনালী ব্যাংককে ১৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার তিনটি চেক দেয়। কিন্তু অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় চেক ডিজঅনার হয়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে চেক ডিজঅনারের মামলা করে সোনালী ব্যাংক। সুদাসলে কোম্পানির দেনাও কমেনি।
সে দফায় সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিল হয়ে গেলে গত বছর আবারো গ্রুপটিকে একই সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ নেয় সোনালী ব্যাংক। ২০১৭ সালের আগস্টে অলটেক্সের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুদাসলে মোট ৩৬৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা পাওনার মধ্যে ১২৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেয় সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ। এর মধ্যে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ২৩৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকার বিপরীতে ৭২ কোটি টাকার সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ তিন বছরের মধ্যে ঋণের টাকা পরিশোধ করার শর্ত দেয়া হয়। এক্ষেত্রেও সুদহার নির্ধারণ করা হয় ১০ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় শাখায় অলটেক্সের নামে থাকা চলতি হিসাব থেকে ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট হিসেবে কেটে রাখার কথা ছিল সোনালী ব্যাংকের।
অলটেক্স ফ্যাব্রিকসের কাছে থাকা ৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার মধ্যে সুদ বাবদ ২০ কোটি ৮১ লাখ টাকা মওকুফ করে সোনালী ব্যাংক। অবশিষ্ট ২৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার শর্ত নির্ধারণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির আংশিক জমি কিনতে আগ্রহী ক্রেতার নামে থাকা ৬৪ লাখ এবং ২০১৩-১৬ সাল পর্যন্ত কিস্তি হিসেবে ব্যাংকে জমা দেয়া ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর পরও ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্টে ঘাটতি থেকে যায়। তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে টাকা আদায় হবে, এ আশায় সে সময় প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছিল ব্যাংকের পর্ষদ।
একইভাবে গত বছর গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান অলটেক্স স্পিনিংয়ের ৩৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকার সুদ মওকুফের পর ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ৪৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে চলতি হিসাবে ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা জমা থাকায় ৯০ দিনের মধ্যে অবশিষ্ট ৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা জমা দেয়ার শর্ত দেয়া হয়। এ শর্তও পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় অলটেক্স স্পিনিংয়ের কাছে ব্যাংকটির ঋণের স্থিতি ৮০ কোটি টাকা অপরিবর্তিত রয়ে যায়।
সূত্র: বণিকবার্তা।