বছরে ২১৬ জনের বেশি মৃত্যু বজ্রপাতে, দরকার সচেতনতা

প্রচ্ছদ » আর্ন্তজাতিক » বছরে ২১৬ জনের বেশি মৃত্যু বজ্রপাতে, দরকার সচেতনতা

পুঁজিবাজার রিপোর্ট প্রতিবেদক : বজ্রপাত এ অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই একটু বেশি হয়। তবে আগের তুলনায় বর্তমানে মৃত্যু ঘটনা ঘটছে বেশি।

বছরে মারা যাচ্ছে ২১৬ জনের বেশি। যে কারণে সরকার বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকাভুক্ত করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বজ্রপাত নিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে মৃত্যু হার কমানো সম্ভব।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল এই অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই বেশি বজ্রপাত হয়। কেন না, এই অঞ্চলে বজ্র মেঘের সৃষ্টিই হয় বেশি। বজ্রমেঘ বেশি তৈরি হওয়ার কারণও প্রাকৃতিক। পৃথিবীর আদিকাল থেকেই বজ্রপাত ছিল। তবে মৃত্যুর হার ইদানিং বেশি বলে নজরে আসছে।

দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় মার্চ থেকে জুন মাসে। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। আর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়, যারা ঘরের বাইরে থাকেন। এক্ষেত্রে কৃষক বা শ্রমিক শ্রেণির মানুষের মৃত্যু বেশি হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মৃত্যু বরণ করেছেন ২ হাজার ১৬৪ জন মানুষ। এক্ষেত্রে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১১ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন ও ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৩৬ জন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২১৬ জনের বেশি মানুষ প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে মৃত্যুবরণ করেছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই সময়ের মধ্যে বজ্রপাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গেল এক দশকে ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প, ভূমি ধসে এত মানুষ মারা যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বজ্রপাতে মৃত্যু হার বাড়ার সঙ্গে জলাবায়ু পরিবর্তনে সম্পর্ক আছে কিনা তা প্রমাণিত নয়। কেন না, গত কয়েক বছরে বজ্রপাত বাড়েনি। তবে মৃত্যু হার বেড়েছে। তার অর্থ মৃত্যু যেসব কারণে কম হতো, সেই বিষয়গুলোর উপস্থিতি কমে গেছে।

বজ্রপাতে মৃত্যু কমানো একটি বড় উপায় বড় কোনো গাছ। মাঠে কোনো বড় গাছ থাকলে, বজ্রপাত মানুষের শরীরে না পড়ে সেটা বড় গাছেই পড়ে বলে বিভিন্ন গবেষণায় ওঠে এসেছে। আর বাংলাদেশে দিনদিন গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে বাইরে কর্মরত কৃষক বা শ্রমিক শ্রেণি বজ্রপাতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে আবাহওয়াবিদ আফতাব উদ্দিন বলেন, বজ্রপাতের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাপপ্রবাহ ও পশ্চিমা লঘুচাপের মিশ্রণ। অর্থাৎ দক্ষিণের গরম বাতাস আর পশ্চিমা লঘুচাপের মিশ্রণের কারণে প্রচুর বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। মেঘের মধ্যে থাকা ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের গঠন ও পরিবহনের ফলে বজ্রপাত হয়।

বজ্রপাত তিন ধরনের। এক ধরনের বজ্রপাত এক মেঘ থেকে আরেক মেঘে হয়। অন্য ধরনের বজ্রপাত এক মেঘের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে হয়। আর অন্যটি হয় মেঘ থেকে ভূমিতে, আর এটি যত ক্ষতির কারণ।

কারো ওপর বজ্রপাত হলে, সেটা থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে বজ্রপাত যাতে এড়িয়ে চলা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপন মৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে খোলা মাঠে কিংবা ভবনের ছাদে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদের সাবেক ডিন ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম। এতে মানুষ যদি ঘরের বাইরে কম বের হলে স্বাভাবিক ভাবেই কম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। এ ব্যবস্থা ভারতে কাজে লাগিয়ে সাড়া পাওয়া গেছে।

এদিকে আর্লি ওয়ার্নিং দেওয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে বলে দাবি করছে ঢাবির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ। তারা আবহাওয়া অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য আলোচনার উদ্যোগও নিচ্ছে।

অধ্যাপক মাকসুম কামাল বলেন, সরকারিভাবে যদি মাঠে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা যায়, সেটা অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। এছাড়া মানুষকে সচেতন হতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার এর আগে তালগাছ লাগানোর কর্মসূচি হাতে নিলেও বর্তমানে মৃত্যু হার বাড়ায় পরিকল্পনা নিয়েছে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের। এক্ষেত্রে হাওর অঞ্চলকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া জাতীয় বিল্ডিং কোডে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড বসানো বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এ নিয়ে প্রচারও চালাচ্ছে। তারা লিফলেটও বিলি করছে। এক্ষেত্রে বজ্রপাতের সময় বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে বজ্রপাতের ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ না করা, প্রতিটি ভবনে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন, খোলাস্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যাওয়া, বাড়িতে আলাদা আলাদা কক্ষে অবস্থান নেওয়া, খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় না নিয়ে কমপক্ষে চার মিটার দূরে থাকা, ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার, তার ও খুঁটি থেকে থাকা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আনপ্লাগ করা, আহতদের বৈদ্যুতিক শকে মতো চিকিৎসা দেওয়া।

এছাড়া এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রপাত বেশি হয়। এজন্য আকাশে মেঘ দেখা গেলে ঘরে অবস্থান করা, দ্রুত দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া, জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় না থাকা এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকা, ঘন-কালো মেঘ দেখা গেলে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হওয়া, উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার, ধাতব খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা, খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে না থাকা, কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়া, বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্যে অবস্থান করলে, গাড়ির থাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ না ঘটানো এবং সম্ভব হলে গাড়িটিকে নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া এবং বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সূত্র: বাংলানিউজ।

পুঁজিবাজার রিপোর্ট – নূ/আ/সি/ ০৮ জুন , ২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *